দীর্ঘদিন মানবজাতি একজন মুক্তিদাতার অপেক্ষায় ছিল। কারণ ঈশ্বর প্রবক্তাদের মাধ্যমে বলেছিলেন, তিনি মানবজাতিকে পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য একজন মুক্তিদাতাকে পাঠাবেন। যথাসময়ে মুক্তিদাতা যীশু খ্রিষ্টের জন্ম হলো। অতি দীন বেশে গোয়াল ঘরে তাঁর জন্ম হলো। মানুষকে উদ্ধার করার জন্য তিনি সীমাহীন যন্ত্রণাভোগ করে ক্রুশের উপর মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু মৃত্যুই তাঁর শেষ নয়, মৃত্যুর তিন দিন পর তিনি পুনরুত্থিত হলেন। মৃত্যুকে জয় করে তিনি মানুষকে পাপের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছেন।
যীশুর নতুন ধরনের কথা শুনে, তাঁর জীবন ও আশ্চর্য কাজগুলো দেখে অগণিত মানুষ দিন দিন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগল। তা দেখে ইহুদি ধর্মনেতা ও ফরাসিরা তাঁর উপর খুব ক্ষেপে উঠেছিল। যীশুকে মেরে ফেলার জন্য তারা নানারকম ষড়যন্ত্র করতে লাগল । তারা উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় রইল। শেষ পর্যন্ত যীশুর একজন অন্যতম শিষ্য, যুদাস (যিহুদা), ত্রিশটি রুপার টাকার বিনিময়ে যীশুকে শত্রুদের হাতে তুলে দিল। যীশু কিন্তু সবকিছু জানতেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে একটি ভোজের আয়োজন করেছিলেন। ভোজের শেষে তিনি শিষ্যদের নিয়ে গেৎসিমানি বাগানে গেলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি শিষ্যদের বললেন “তোমরা এখানে বস, আমি ততক্ষণ প্রার্থনা করে আসি।” সঙ্গে তিনি পিতর, যাকোব ও যোহনকে নিয়ে গেলেন। এই সময় তিনি আশঙ্কায় উদ্বেগে কেমন যেন অভিভূত হয়ে পড়লেন। তিনি তাঁদের বললেন, “দুঃখে আমি যেন মরতে বসেছি! তোমরা এখানে বরং অপেক্ষা কর আর জেগেই থাক!” তিনি তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন। তখন তিনি বলে উঠলেন, “পিতা! তোমার পক্ষে তো সবই সম্ভব। এখন এই পানপাত্রটি আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও! তবুও আমি যা চাই, তা নয়—তুমিই যা চাও, তা ই হোক!”
তারপর ফিরে এসে তিনি দেখলেন, শিষ্যেরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। পিতরকে তিনি বললেন: “সিমোন, তুমি কি ঘুমোচ্ছ? এক ঘণ্টাও কি আমার সঙ্গে জেগে থাকতে পারলে না! তোমরা জেগে থাক আর প্রার্থনা কর, যাতে প্রলোভনে না পড়। মনে উৎসাহ আছে বটে, কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ যে বড় দুর্বল!” তারপর আবার সেখান থেকে গিয়ে তিনি সেই একই কথা বলে প্রার্থনা করলেন। তারপর আবার ফিরে এসে দেখলেন, শিষ্যেরা আবারও ঘুমিয়ে পড়েছেন: তাঁদের চোখের পাতা যে ভারী হয়ে উঠেছিল। তাঁরা তাঁকে যে কী উত্তর দেবেন, তা ভেবেই পেলেন না। তৃতীয়বার যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন তাঁদের বললেন, “সে কী,তোমরা এখনও ঘুমোচ্ছ! এখনও বিশ্রাম করছ না, যথেষ্ট হয়েছে। সময় এসে গেছে। দেখ, এবার মানবপুত্রকে শত্রুর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।” তারপর পূর্বপরিকল্পনামতো যুদাস এসে যীশুকে চুম্বন করল এবং শত্রুরা যীশুকে গ্রেপ্তার করল। মহাসভায় যীশুর বিচার হলো। শেষ পর্যন্ত তাঁর শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। যীশু নীরবে সব অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করলেন।” (মার্ক ১৪:৩২-৪২)
পিলাতের বিচারে সিদ্ধান্ত হলো যে যীশুর শাস্তি ক্রুশীয় মৃত্যুদণ্ড। তখন শত্রুরা যীশুর কাঁধে একটি অতি ভারী ক্রুশ চাপিয়ে দিল। যীশুর মাথায় পরিয়ে দিল একটি কাঁটার মুকুট। নানাভাবে তারা তাঁকে নির্যাতন করতে লাগল। কাঁটার মুকুট পরানো মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করতে লাগল, মুখে থুথু দিল, অকথ্য ভাষায় তাঁকে গালিগালাজ করল, চড়থাপ্পড় মারতে লাগল, ‘ইহুদিদের রাজা' বলে অপমান ও উপহাস করতে লাগল। যীশু নীরব থাকলেন। এভাবে মারতে মারতে তারা যীশুকে নিয়ে চলল কালভেরী পর্বতের দিকে কষ্টে জর্জরিত হয়ে পথে যীশু তিনবার পড়ে গেলেন। শত্রুরা টেনে হিঁচড়ে তাঁকে তুলল ও ক্রুশ বহন করতে বাধ্য করল। তাঁর গা থেকে অঝোরে রক্ত ঝরতে লাগল। নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে যীশু শেষ পর্যন্ত কালভেরী পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানে পৌঁছে দুইজন চোরের মাঝখানে রেখে শত্রুরা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করল। ক্রুশের উপর তিনি তিন ঘণ্টা অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করলেন। তারপর তিনি ক্রুশের উপর প্রাণত্যাগ করলেন।
নির্দোষ যীশুর এমন করুণ মৃত্যু কেন হলো? ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে পিতার ইচ্ছা পূর্ণ করতেই যীশু মানুষ হয়ে এসেছিলেন। মানুষকে পাপ ও শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যীশু ক্রুশীয় মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন। ক্রুশে মৃত্যুবরণের পর ক্রুশ থেকে নামিয়ে যীশুকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। আরিমাথিয়ার যোসেফ নামে একজন গণ্যমান্য লোক ছিলেন। তিনি যীশুকে ক্রুশ থেকে নামিয়ে ক্ষোম বস্ত্রে তাঁকে জড়ালেন । তারপর পাহাড়ের গায়ে কেটে নেওয়া একটি সমাধিগুহায় তাঁকে সমাহিত করলেন। একখানা পাথর গড়িয়ে সমাধির মুখটি বন্ধ করে দেওয়া হলো ।
মাগদালার (মগ্দলিনী) মারীয়া, যাকোবের মা মারীয়া আর সালোমে জানতেন যীশুকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছিল। যীশুর গায়ে সুগন্ধি লেপনের জন্য রবিবার দিন সকালে সূর্য উঠার আগেই তাঁরা যীশুর সমাধিস্থানে এলেন। তাঁরা বলাবলি করছিলেন কীভাবে তাঁরা সমাধিগুহার এত বড় পাথরখানি সরাবেন। কিন্তু সমাধির দিকে তাকাতেই তাঁরা লক্ষ করলেন পাথরখানি সরানো রয়েছে।
সমাধির ভিতরে ঢুকে তাঁরা দেখতে পেলেন দীর্ঘ শুভ্র পোশাক পরা একজন যুবক ডান দিকে বসে আছেন। তাঁরা ভয়ে চমকে উঠলেন। কিন্তু তিনি তাঁদের বললেন, “ভয় পেয়ো না; তোমরা তো নাজরেথের যীশুকেই খুঁজছ, যাকে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল! তিনি কিন্তু পুনরুত্থিত হয়েছেন, তিনি এখানে নেই। এই দেখ তাঁকে এইখানেই রাখা হয়েছিল! এখন যাও, তাঁর শিষ্যদের আর বিশেষ করে পিতরকে গিয়ে এই কথা জানাও : “তিনি তোমাদের আগেই গালিলেয়ায় যাচ্ছেন। তোমরা সেখানেই তাঁর দেখা পাবে, তিনি তোমাদের যেমনটি বলেছিলেন!” তখন তাঁরা দৌড়ে গেলেন শিষ্যদের কাছে। তাঁরা তাঁদেরকে বললেন : “ওরা প্রভুকে কবর থেকে তুলে নিয়ে গেছে, আর আমরা জানি না, কোথায় তাঁকে রেখেছে।” তখন পিতর ও যোহন দৌড়ে কবরের কাছে এলেন। তাঁরাও যীশুর সমাধিটি দেখলেন। কিন্তু যীশুকে সেখানে দেখলেন না। তখন তাঁদের মনে হলো যে, যীশু তাঁদেরকে আগেই বলেছিলেন তিনি মৃত্যু থেকে পুনরুত্থান করবেন।
রবিবার দিন সকালের দিকে পুনরুত্থান করার পর যীশু প্রথমে দেখা দিলেন মাগদালার মারী- য়ার কাছে। মারীয়া তখন এই খবর শিষ্যদের জানালেন। পরে যীশু অন্যান্য শিষ্যকে ও কয়েকবার দেখা দিলেন। একবার তিনি এম্মাউস যাওয়ার পথে দুইজন শিষ্যের কাছে দেখা দিলেন। আর একবার শিষ্যেরা বদ্ধ ঘরে একসঙ্গে ছিলেন। সেখানে সবার মাঝখানে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন এবং বললেন, তোমাদের শান্তি হোক। এই কথা বলে তিনি তাদের উপর ফুঁ দিলেন আর বললেন,“তোমরা পবিত্র আত্মাকে গ্রহণ কর। তোমরা যার পাপ ক্ষমা করবে, তার পাপ ক্ষমা করা হবে। যার পাপ ক্ষমা না করবে, তার পাপ ক্ষমা না করাই থাকবে।”এভাবে তিনি বেশ কয়েকবার শিষ্যদের দেখা দিলেন। পুনরুত্থিত হয়ে যীশু মৃত্যু ও শয়তানের সমস্ত শক্তির উপর জয় প্রতিষ্ঠা করলেন। ঈশ্বরের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলেন। তিনি সকল মানুষের মুক্তিদাতা হলেন ।
পুনরুত্থানের পর যীশু চল্লিশ দিন এই পৃথিবীতে ছিলেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন স্থানে শিষ্যদের কাছে দেখা দিয়েছেন। তিনি তাঁদেরকে নানারকম নির্দেশ দান করেছেন । বিশেষ করে তিনি তাঁদের কাছে পবিত্র আত্মাকে পাঠিয়ে দেবার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।একদিন যীশু শিষ্যদেরকে গালিলেয়ার একটি পাহাড়ে যেতে বললেন। শিষ্যগণ সেখানে গেলেন। তাঁরা যীশুকে সেখানে দেখে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম জানালেন। তখন যীশু তাঁদের কাছে এসে বললেন : “স্বর্গে ও পৃথিবীতে পূর্ণ অধিকার আমাকে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যাও : তোমরা গিয়ে সকল জাতির মানুষকে আমার শিষ্য কর; পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে তাদের দীক্ষাস্নাত কর। তোমাদের যা-কিছু আদেশ দিয়েছি, তাদের তা পালন করতে শেখাও। আর জেনে রাখ, জগতের সেই অন্তিমকাল পর্যন্ত আমি সর্বদাই তোমাদের সঙ্গে আছি।” এই বলে তিনি দুই হাত তুলে শিষ্যদের আশীর্বাদ করলেন। আশীর্বাদ করতে করতেই তিনি তাঁদের ছেড়ে চলে গেলেন। একটি মেঘবাহন এসে যীশুকে নিয়ে গেল। যীশু স্বর্গে উন্নীত হলেন। তাঁরা প্রণত হয়ে তাঁর আরাধনা করলেন। তারপর মহানন্দে যেরুসালেমে ফিরে এলেন। সেখানে শিষ্যেরা পবিত্র আত্মার অপেক্ষায় থাকলেন।
যীশু সশরীরে পুনরুত্থান করে আমাদের সাথে সর্বদা রয়েছেন। কিন্তু তাঁর দেহ আগের মতো নেই। তাঁর এই দেহ হলো গৌরবান্বিত দেহ। আমাদের জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন ঠিক যেন যীশুর যাতনাভোগ ও মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করি। আবার এর পরে আমরা অভিজ্ঞতা লাভ করি যীশুর পুনরুত্থান। যেমন, আমরা যখন বহু কষ্ট করে পড়াশুনা করি বা এরকম কোনো কষ্টকর কাজ করি তখন যীশুর মতো আমরা যন্ত্রণাভোগ ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যাত্রা করি। কিন্তু যখন আমরা ভালোভাবে কৃতকার্য হই তখন পুনরুত্থিত যীশুই যেন আমাদের সাথে থাকেন।
এ ছাড়া, আমরা যখন কষ্ট করে পাপের প্রলোভনকে জয় করতে পারি তখন যীশুর পুনরুত্থানকেই নিজের জীবনে দেখতে পাই। কারো জন্য কষ্ট করে কোনো ভালো কাজ করেও আমরা যে-আনন্দ পাই তখন পুনরুত্থিত যীশুই আমাদের সাথে থাকেন। এভাবে পুনরুত্থিত যীশু স্বর্গে গেলেও প্রতিদিন তিনি আমাদের সাথেই রয়েছেন।
যীশু আমাদের পরিত্রাণ সাধন করার জন্য এ জগতে এলেন। গেৎসিমানি বাগানে তাঁর মর্মবেদনা হলো; তিনি অসহনীয় যন্ত্রণাভোগ করে মৃত্যুবরণ করলেন; তৃতীয় দিনে তিনি পুনরুত্থান করলেন। অনেকবার তিনি প্রেরিত শিষ্যদের কাছে দেখা দিলেন ৷ এরপর তিনি স্বর্গারোহণ করলেন। পুনরুত্থিত যীশু সর্বদা আমাদের সাথে রয়েছেন।
১। ছোট দলে তোমার জীবনের এমন একটি ঘটনা সহভাগিতা কর যার মধ্য দিয়ে যাতনা, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের অভিজ্ঞতা লাভ করেছ।
২। শূন্য কবরের পাশে পুনরুত্থিত যীশুর চিত্র অঙ্কন কর।
ক) যীশু যন্ত্রণাভোগ ও ক্রুশে মৃত্যুবরণ করেছেন মানুষকে ___ করতে ।
খ) যীশুর কথা, আশ্চর্য কাজ দেখে ___ ও ফরিসিরা তাঁর ওপর খুব খেপে উঠেছিল ।
গ) যীশুকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছিল ___ ।
ঘ) শেষ ভোজের পর যীশু শিষ্যদের নিয়ে ___ নামক স্থানে গিয়েছিলেন।
ঙ) পিলাতের বিচারে যীশুর শাস্তি হয়েছিল ___ ।
ক। “এই পানপাত্রটি আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও! | ক। যীশু স্বর্গে উন্নীত হলেন। |
খ। যীশু তাদের উপর ফুঁ দিলেন আর বললেন, | খ। যীশুর পুনরুত্থান আামদের জীবনে দেখতে পাই |
গ। একটি মেঘবাহনে চড়ে | গ। প্রতিদিন তিনি আমাদের সাথেই আছেন। |
ঘ। আমরা প্রলোভনকে জয় করতে পারলে | ঘ। আমাদের পরিত্রাণ সাধন করলেন। |
ঙ। পুনরুত্থিত যীশু স্বর্গে গেলেও | ঙ। তবুও আমি যা চাই, তা নয়, তুমিই যা চাও, তাই হোক!” |
চ। তোমরা পবিত্র আত্মাকে গ্রহণ কর ৷ |
ক) কতো টাকার বিনিময়ে যুদাস যীশুকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল ?
খ) শত্রুরা যীশুকে কী বলে উপহাস করেছিল ?
গ) পুনরুত্থানের পর যীশু কাকে প্রথম দেখা দিয়েছিলেন ?
ঘ) যীশু তাঁর শিষ্যদের কার নামে মানুষকে দীক্ষাস্নাত করতে বলেছিলেন ?
ঙ) পুনরুত্থানের কতোদিন পর যীশু স্বর্গারোহণ করেছিলেন?
ক) যীশুর যাতনাভোগ ও মৃত্যু সম্পর্কে লেখ।
খ) যীশুর পুনরুত্থানের ঘটনাটি লেখ ।
গ) যীশুর স্বর্গারোহণের ঘটনাটি বর্ণনা কর।
আরও দেখুন...